তিনি চলে গেলেন। দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল, ঠিক যেন একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তার পিঠটা ক্রমশেই ছোট হতে হতে রাস্তার মোড়ে মিশে গেছে। হয়তো ফিরে তাকালে না, নয়তো আমি দেখতে পাইনি।
ঘরে ফিরে এসে চায়ের কাপটা হাতে নিলাম। ঠান্ডা হয়ে গেছে। আজ সকালে তিনিই বানিয়ে দিয়েছিলেন, দুধ-চিনি একদম বরাবর আমার মতো করেই বানিয়ে ছিলেন। কাপটা ধরে বসে রইলাম। জানালা দিয়ে একটা পাখি উড়ে গেল। আকাশটা নীল, কিন্তু আমার চোখে যেন ধুসর।
মায়ের ডাক শুনলাম। বললেন, "এতক্ষণ কী করছ?"
উত্তর দিলাম, "কিছু না।"
মা নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন। তিনি চুপ করে আমার পাশে বসে গেলেন। তারপর বললেন, "জীবন এত ছোট যে, কারো চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই এটা পার করে দেয়া যায়।" কথাটা শুনে আমার গলাটা শুকিয়ে গেল।
সেই যে স্কুলে প্রথম দেখেছিলাম তাকে। লাইব্রেরির এক কোণে বসে বই পড়ছিল, চশমার ফাঁকে চোখ দুটো যেন আরও গভীর হয়ে গিয়েছিল। আমি তখনই বুঝেছিলাম, এটা ভালোবাসা নয়, এটা তার চেয়েও বড় কিছু। কিন্তু আজ সে চলে গেল, শুধু একটা ছোট নোট রেখে গেল— "আমি যাচ্ছি।" বিকেল হয়ে এল। বাইরে বৃষ্টি নামল। ফোঁটা ফোঁটা পানি জানালার কাঁচে আঘাত করছিল। মনে হচ্ছিল, বৃষ্টিটাও কাঁদছে। মোবাইলটা হাতে নিলাম। তার নামটা সার্চ করলাম। প্রোফাইল পিকচারটা এখনও সেই পুরনোটা দেওয়া আছে—আমি তোলা একটা ছবি, সমুদ্রের পাড়ে হাসতে হাসতে। আজ থেকে সে শুধুই একটা স্মৃতি।
রাতটা কাটল না। ঘুম আসে না যখন, তখন সময় যেন আরও ধীরে চলে। আমি জানালার পাশে বসে রইলাম। আকাশে তারা দেখা যাচ্ছিল। একটা তারা খসে পড়ল। মনে হলো, হয়তো সেটা আমারই কোনোকিছু।
সকালে উঠে দেখলাম, চায়ের কাপটা এখনও টেবিলে আছে। মা সেটা তুলে নিয়ে গেলেন। বললেন, "একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।" আমি জানি, ঠিক হবে না। কিন্তু একদিন এটা নিয়ে আর ততটা ব্যাথা হবে না।
জীবন এত ছোট যে, তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই এটা পার করে দিলাম। হয়তো সে ফিরে আসবে, হয়তো না। কিন্তু এই তাকিয়ে থাকাটাই এখন আমার নিত্যদিনের সঙ্গী, তুমি ভালো থেকো প্রিয়?